অধ্যায় ১ : টানেলের ওপারে আলো
স্টিম ইঞ্জিন চালিত ট্রেনটা গর্জন তুলে অন্ধকার টানেল থেকে বের হয়ে এলো। হুইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দ ছড়িয়ে পড়ল শীতের বিকেলের সোনালী আলোয়। চারপাশে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সবুজ সতেজ ঘাস, আকাশে পড়ন্ত বিকেলের মায়া, সোনালী ঝলমলে রোদ যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছে।
ট্রেন ধীরে ধীরে এসে থামলো একটি ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে। সেখানে নেমে এলেন একজন পুরুষ। কাঁচা-পাকা ছোট ছোট দাড়ি, কালো ফ্রেমের চশমা, কাঁধে ঝোলানো একখানা পুরোনো সাইড ব্যাগ। মুখে এক ধরনের হারানো বেদনার ছাপ, যেন অতীতের ভারে তার চোখ এখনও ঝলমল করছে।
ঠিক সেই সময় তার চোখ পড়লো — প্ল্যাটফর্মের এক কোণে বসে থাকা এক নারীর দিকে।
সাদা শাড়ি, সোনালী আঁচল, আঁচলে সূক্ষ্ম সোনালী সুতোয় আঁকা ছোট ছোট ফুল। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, কপালের কাছে কালো চুলের ভেতরে কয়েকটি সাদা চুলের রেখা, তবুও তার গাঢ় কালো চোখ এমন আকর্ষণীয় যে কোনো পুরুষই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাবে। ঠোঁট হালকা গোলাপি, মুখে অদ্ভুত শান্তি।
নারীর হাতে একটি বাদামী রঙের ডাইরি, তিনি মাথা নিচু করে তাতে ডুবে ছিলেন। তিনি মেঘ। রূপের বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। যেন এতদিনের হারানো পৃথিবী আবার সামনে ফিরে এসেছে।
অধ্যায় ২ : এক কাপ চা ও একটি ডাইরি
রূপ প্ল্যাটফর্মের এক হকারের কাছ থেকে দু’কাপ চা কিনে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে মেঘের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
রূপ: “আমি কিন্তু উপন্যাস, ডাইরি বা বই যাই পড়িনা কেন, সাথে কিন্তু চা চাই।”
মেঘ চমকে তাকালেন। তার ঠোঁট কেঁপে উঠলো—
মেঘ: “রূপ… তুমি?”
রূপের চোখে মৃদু হাসি—
রূপ: “কেমন আছো মেঘ?”
মেঘ: “ভালো… আর তুমি? তোমার একই অবস্থা রূপ? কি করছো নিজের?”
রূপ: “এই নাও তোমার চা। আমার কথা বাদ দাও। বলো, বাচ্চারা কেমন আছে? তোমার স্বামী কেমন আছেন?”
মেঘ: “সবাই ভালো… কিন্তু তোমাকে দেখে বিশ্বাস করতে পারছি না, এত বছর পর আবার দেখা।”
রূপ: “হ্যাঁ… হয়তো সাত-দশ বছর পর। সময় কেমন পাল্টে যায়, তাই না?”
একটু থেমে মেঘ তাকালেন সোজা রূপের চোখে।
মেঘ: “একটা সময় তুমি বলতে— আমি মেঘ, তাই তোমার আকাশে লুকোচুরি করি… এই আছি, এই নাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তুমি-ই আমাকে সেই খেলায় ফেলে দিলে।”
রূপ নির্বাক তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
অধ্যায় ৩ : ফ্ল্যাশব্যাক – নীল ওড়নার প্রথম দেখা
১১ বছর আগের এক দুপুর। রূপ তখন তরুণ, হাতে নতুন লেখা কবিতা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের রাস্তায়। হঠাৎই তিনি দেখলেন—একটি কালো বোরখার ভেতর লুকানো মুখ, কিন্তু মাথায় নীল ওড়না। বাতাসে উড়তে থাকা ওড়নার আড়াল থেকে এক জোড়া গভীর কালো চোখ তার দিকে তাকিয়েছিলো।
রূপ মনে মনে লিখলেন—
“নীল ওড়নার ভেতরে তুমি কে? তোমার চোখে কেন আকাশের মতো ডাকে?”
সেদিন তাদের কথা হয়নি, শুধু চোখের মিলনে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
অধ্যায় ৪ : শহরের ভিড়ে আবার দেখা
৩ বছর পর। মেঘ তখন প্রথম সন্তানের মা। শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। ভিড়ভাট্টার মধ্যে হঠাৎ রূপের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এক মুহূর্তের জন্যই তাদের চোখ মিললো।
মেঘ: “তুমি?”
রূপ: “হ্যাঁ… তবে কথা বলার সময় নেই।”
ভিড়ের মধ্যে আবার তারা হারিয়ে গেলেন। কিন্তু সেই অল্প কথাই তাদের ভেতরে অগ্নিকণার মতো জ্বলে উঠেছিল।
অধ্যায় ৫ : অসমাপ্ত কবিতা
বর্তমানে প্ল্যাটফর্মে রূপ অপলক তাকিয়ে আছেন মেঘের দিকে। তার চোখে জমে থাকা আবেগ আর দীর্ঘশ্বাস শব্দ হয়ে বের হলো—
রূপের কবিতা মেঘের উদ্দেশ্যে:
“হে আমার অসমাপ্ত কাব্য, আমার অসমাপ্ত উপন্যাস, আমার অতৃপ্ত ভালোবাসা—
তোমাকে চাইলে ছুঁতে পারি না, তোমাকে চাইলে গন্ধ নিতে পারি না।
তবুও তুমি আছো—
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে।
হে আমার মহারানী, আজ আবার তোমার নতুন রূপে আমি প্রথম প্রেমে পড়ে গেলাম।”
কবিতা শুনে মেঘের চোখ ভিজে উঠলো। তিনি রূপের চশমা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে আবার চোখে পরিয়ে দিলেন।
রূপ ধীরে বললেন: “তুমি এখানে কেন?”
মেঘ: “পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। আর তুমি?”
রূপ: “আজ তোমার আকাশে আমি মেঘ হয়ে উঁকি দিতে এসেছি।”
(রূপ ব্যাগ থেকে নতুন একটি ডাইরি বের করে মেঘের হাতে দিলেন)
রূপ: “এটা আমার অসমাপ্ত লেখা। সাবধানে পড়বে।”
অধ্যায় ৬ : বিদায়ের টানেল
ট্রেনের বাঁশি বাজলো। রূপ উঠে দাঁড়ালেন।
রূপ: “ভালো থেকো মেঘ… মহারানীর মতো থেকো।”
রূপ ট্রেনে উঠে বসলেন।
মেঘ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি মনে মনে ফিসফিস করে বললেন—
“ভালোবাসি তোমায়, শুধু ভালোবাসি… তুমি আমার কাব্য, তুমি আমার অসমাপ্ত উপন্যাস।”
ট্রেন চলতে শুরু করলো। মেঘ শেষবারের মতো তাকিয়ে রইলেন রূপের দিকে। ট্রেন যখন আবার এক অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করলো, তখনই দূর থেকে তার সন্তানের ডাক কানে এলো। বাস্তব তাকে টেনে নিয়ে এলো আবার।
কিন্তু হাতের মুঠোয় রইলো রূপের দেওয়া সেই নতুন ডাইরি।
দূর থেকে তার স্বামীকে আসতে দেখে চোখ মুছে নিলেন।
তবুও মনে মনে ভাবলেন—
“আবার কবে দেখা হবে?”
দুজনেই জানতেন—এই প্রেমের কোনো পূর্ণতা নেই।
তবুও তাদের ভালোবাসা থেকে গেলো, অসমাপ্ত কবিতা হয়ে, চিরন্তন বেদনা হয়ে।
© 2025 ছায়া আলো – অনুমতি ছাড়া কপি বা পুনঃপ্রকাশ করা নিষিদ্ধ ❌

0 মন্তব্যসমূহ