কাব্য ও অরিণার প্রেম


পরীর রাজপ্রাসাদ ও অদ্ভুত প্রেম
কাব্য ও অরিণার প্রেম
লেখক: রূপম • প্রকাশনার প্রি-রিলিজ

অধ্যায় ৩: পরীর রাজপ্রাসাদ

সেতুর ওপারেই যেন নতুন এক দুনিয়া। ঝরনার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসছে, আর কাব্যের সামনে খুলে যাচ্ছে অন্য এক জগতের দরজা। আকাশ তখনো ভরা চাঁদের আলোয়, কিন্তু এখানে আলোটা আরও নির্মল, যেন আকাশ নিজেই নেমে এসেছে মাটিতে।

সাদা পাথরে গড়া পথটা সরু আর মোলায়েম, যেন মানুষের জন্য নয়—পায়ের ছোঁয়া পেলেই আলো ঝলমল করে ওঠে। পথের দুই পাশে ফুলের বাগান, যেগুলোতে ফুটে আছে নীল, লাল, বেগুনি আর অচেনা সব রঙের ফুল। কিছু ফুলের পাপড়ি অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছে, যেন তারা জোনাকির মতো ঝিলমিল করছে। বাতাসে এক ধরনের সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, যা মনের গভীরের নিস্তব্ধতাকে স্পর্শ করে যায়।

কাব্য হাঁটছে ধীরে ধীরে। তার পাশে রূপালি পোশাকের মেয়েটি—যেন অন্ধকার রাতের মাঝে নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে। তার পদক্ষেপ এত হালকা, মনে হয় সে যেন মাটিকে স্পর্শই করছে না। মাঝে মাঝে তার চুল হাওয়ায় উড়ে এসে কাব্যের গালে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কাব্যর ভেতরে অদ্ভুত কাঁপন জাগিয়ে দিচ্ছে।

প্রাসাদের প্রথম দৃশ্য

তিন পাহাড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক রাজপ্রাসাদ। সাদা রঙের সেই প্রাসাদ চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। গম্বুজগুলো আকাশ ছুঁয়েছে, জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে রুপালি আভা। সামনে আছে বিশাল ফোয়ারা, যার পানি থেকে বের হওয়া কণাগুলো বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে ছোট ছোট তারার মতো ঝিকমিক করছে।

ফোয়ারার চারপাশে ফুলের বাগান, মাটিতে সাদা পাথরের রাস্তা, প্রতিটি পাথর যেন আলাদা করে পালিশ করা। পাশে পাহাড়ি ঝরনা বেয়ে নেমেছে স্রোত, যা গিয়ে মিশেছে ছোট্ট খালে। সেই খালের উপর সাদা সেতু—মাটির সাথে এত সুন্দর মানিয়ে গেছে যে মনে হয় যেন প্রাচীন কোনো চিত্রকরের আঁকা ছবি।

কাব্য থমকে দাঁড়াল। তার চোখ বিস্ময়ে ভরে উঠল। এটা কি সত্যি? নাকি কোনো মায়া? সে হাত বাড়িয়ে সাদা পাথরের দেয়াল ছুঁয়ে দেখল। ঠান্ডা, শক্ত, বাস্তব। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ আরও বেড়ে গেল।

দরজার সামনে

প্রাসাদের বিশাল দরজা খোলা। কিন্তু আশ্চর্য—কোথাও কোনো প্রহরী নেই, নেই কোনো শব্দ। কেবল ঝরনার স্রোত আর ফোয়ারার গান।

“এটাই আমাদের বাড়ি।” - অরিণা

কাব্য বিস্ময়ে তাকাল। “তোমাদের বাড়ি? কিন্তু… তোমরা কারা?”

মেয়েটির ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল। “মানুষ আমাদের এক নামে চেনে। বহু যুগ ধরে গল্পে, কবিতায়, রূপকথায় আমাদের খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সেই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের বাসিন্দা… আমরা পরী।”

কাব্যর শরীর কেঁপে উঠল। ছোটবেলা থেকে শোনা গল্প হঠাৎ বাস্তবে দাঁড়িয়ে গেল। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শব্দ যেন গলা দিয়ে বেরোতেই চাইছিল না।

প্রাসাদের ভেতরে

দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কাব্য অনুভব করল, যেন এক নতুন আকাশে প্রবেশ করেছে। ভেতরে কোনো প্রদীপ নেই, অথচ চারপাশে আলো ভাসছে। দেয়ালগুলো থেকে এক ধরনের মৃদু আভা বেরোচ্ছে।

মেঝেটা স্বচ্ছ সাদা পাথরে তৈরি, যেখানে কাব্যের প্রতিটি পদক্ষেপে আলো জ্বলে ওঠে। বিশাল স্তম্ভগুলোয় খোদাই করা আছে অদ্ভুত চিহ্ন, যেগুলো সে আগে কখনো দেখেনি। ওপরে উঁচু গম্বুজ, যার ভেতরে আটকে আছে তারাভরা রাত।

মাঝখানে এক বিশাল হলঘর। ছাদের দিক থেকে ঝরে পড়ছে আলোর জলধারা। সেটি এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে স্ফটিকের তৈরি আসনগুলোকে। সবকিছু এত শান্ত, অথচ এত জীবন্ত—যেন এই প্রাসাদের প্রতিটি কোণা নিজে নিজে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

কাব্যর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। তার মনে হচ্ছিল—আমি কি আসলেই এখানে দাঁড়িয়ে আছি?

পরীর পরিচয়

মেয়েটি কাব্যের দিকে ঘুরে তাকাল। তার চোখে ছিল নক্ষত্রের দীপ্তি।

“আমি তোমাকে বহুদিন ধরে দেখি, কাব্য। তুমি এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াও, খুঁজতে থাকো অজানাকে। কিন্তু তোমার ভেতরে আছে এক শূন্যতা, যা কেউ পূরণ করতে পারেনি। সেই শূন্যতার জন্যই আজ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো।”

কাব্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সে কখনো কাউকে বলেনি নিজের নিঃসঙ্গতার কথা। অথচ এই অচেনা মেয়েটি সব জানে! তার গলা শুকিয়ে গেল। কাঁপা কণ্ঠে বলল—

“তুমি… তুমি কে?”

মেয়েটি মৃদু হাসল। “আমার নাম অরিণা।”

নামটা শুনেই কাব্যের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। শব্দটা কানে বাজল, কিন্তু এর সাথে অদ্ভুত এক টান জড়িয়ে রইল। যেন এই নাম তার পরিচিত—কোথাও, কোনো জীবনে সে শুনেছে।

অরিণা হাত বাড়িয়ে দিল। “চলো, তোমাকে আমাদের পৃথিবী দেখাই।”

কাব্যর বুকের ভেতর উত্তেজনা আর অজানা ভয় একসাথে ধাক্কা দিচ্ছিল। তবুও সে হাত বাড়াল। আর সেখান থেকেই শুরু হলো কাব্যের জীবনের এক অদ্ভুত অধ্যায়।

অধ্যায় ৪: অদ্ভুত প্রেমের শুরু

প্রাসাদের ভেতরে অরিণা ধীরে ধীরে কাব্যকে নিয়ে হাঁটছিল। চারপাশে নীরবতা, অথচ সেই নীরবতা ছিল সুরেলা—যেন বাতাসের ভেতর কোনো অদৃশ্য বাঁশির সুর বেজে চলেছে। কাব্যের পা কেঁপে যাচ্ছিল, কিন্তু তার চোখ ছিল স্থির—মেয়েটির দিকে।

অরিণার চলন ছিল অদ্ভুত হালকা, যেন সে হাঁটছে না, ভেসে যাচ্ছে। তার চুলের মধ্যে লুকানো চাঁদের আলো কাব্যের মনে বারবার শিহরণ তুলছিল।

প্রথম অন্তরঙ্গ মুহূর্ত

একটা মুহূর্তে তারা পৌঁছাল প্রাসাদের এক উন্মুক্ত বারান্দায়। সামনের দৃশ্য দেখে কাব্যের বুক থেমে গেল—নিচে বিস্তৃত উপত্যকা, যেখানে শত শত ঝরনা একসাথে নেমে আসছে। প্রতিটি ঝরনার জল রুপালি আলো ছড়াচ্ছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় মেঘ বসে আছে, আর সেই মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে অচেনা নক্ষত্র।

অরিণা থেমে দাঁড়াল। “কেমন লাগছে?”

কাব্য হালকা কাঁপা গলায় বলল—“এটা… এটা যেন স্বপ্ন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে আমি সত্যি এখানে আছি।”

অরিণা মৃদু হেসে বলল—“তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে, যদি বলি—এই জায়গাটা শুধু তাদের জন্য খুলে যায়, যারা সত্যিই হৃদয়ের ভেতর থেকে খোঁজে?”

কাব্য তাকিয়ে রইল তার চোখে। “মানে?”

অরিণার দৃষ্টি গাঢ় হলো। “মানুষ অনেকেই ভ্রমণ করে, পাহাড় ঘুরে বেড়ায়, সমুদ্র দেখে। কিন্তু তারা শুধু বাইরের সৌন্দর্য দেখে। ভেতরের সৌন্দর্য কেউ খুঁজে না। তুমি আলাদা। তোমার চোখে শুধু দৃশ্য নয়, তুমি খুঁজে বেড়াও গল্প। তুমি খুঁজে বেড়াও অর্থ। সেই জন্যই তোমার জন্য এই দরজা খোলা।”

অদ্ভুত স্বীকারোক্তি

হঠাৎ কাব্য বুঝতে পারল, তার হাত কাঁপছে। সে ঠান্ডা বাতাসের কারণে নয়—বরং অরিণার উপস্থিতির কারণে।

মৃদুস্বরে সে বলল—“তুমি জানো… আমি জীবনে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। পাহাড়, নদী, মরুভূমি—সব দেখেছি। কিন্তু কখনো কারো পাশে দাঁড়িয়ে মনে হয়নি, এই দৃশ্যটা আমি কাউকে দেখাতে চাই। আজ প্রথম মনে হচ্ছে—আমি চাই এই দৃশ্যটা তুমি দেখো, শুধু তুমি।”

অরিণার চোখ চকচক করে উঠল। সে ধীরে ধীরে কাব্যের দিকে এগিয়ে এল। তার কণ্ঠে হালকা কম্পন—“তুমি জানো কাব্য… আমরা পরীরা ভালোবাসা সম্পর্কে মানুষের চেয়ে অনেক ভিন্নভাবে ভাবি। আমাদের কাছে ভালোবাসা মানে হলো আলো—যা অন্ধকারকে মুছে দেয়। আমি জানি না আমাদের গল্প কোথায় যাবে, কিন্তু এখন… তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই আলোটা আমি খুঁজছিলাম।”

কাব্যের নিঃশ্বাস আটকে গেল। তার ভেতরে যেন সব বাঁধ ভেঙে গেল।

প্রথম স্পর্শ

কাব্য তার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে কোনো মায়া নেই, কোনো ফাঁকি নেই—শুধুই অদ্ভুত এক সত্যের গভীরতা। ধীরে ধীরে সে তার হাতটা ধরল। মুহূর্তেই কাব্যের ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। হাতের ভেতর দিয়ে এক ধরনের আলো বইছে—ঠান্ডা অথচ উষ্ণ, ব্যথা অথচ প্রশান্তি। মনে হচ্ছিল সে এক নতুন জন্ম নিচ্ছে।

অরিণার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। “এখন থেকে তুমি শুধু এক ভ্রমণকারী নও, কাব্য। তুমি আমাদের গল্পেরও অংশ।”

চাঁদের আলোয় প্রতিজ্ঞা

রাত আরও গভীর হলো। আকাশ ভরে উঠল হাজারো অচেনা নক্ষত্রে। বাতাসে ফুলের গন্ধ, আর দূরে ঝরনার সুর। কাব্য আর অরিণা দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। শব্দের প্রয়োজন নেই। তাদের চোখে চোখ মিললেই মনে হচ্ছিল এক মহাবিশ্ব ভরে উঠছে।

হঠাৎ কাব্য নরম স্বরে বলল—“তুমি কি জানো, আমি তোমাকে হারাতে ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তুমি যদি হঠাৎ মিলিয়ে যাও, আমি হয়তো আর কখনো বাঁচতে পারব না।”

অরিণা তার হাত শক্ত করে ধরল। “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যতদিন আলো আছে—আমি তোমার পাশে থাকব।”

চাঁদের আলোতে দুইজনের ছায়া মিশে গেল। আর সেই রাতেই শুরু হলো এক অদ্ভুত প্রেম, যা সময়কে অমান্য করে জন্ম নিল।

পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন

✦ অরিণা ও কাব্যের অদ্ভুত জগতের লুকানো সত্য এখনো উন্মোচিত হয়নি… তুমি কি সাহস করবে জানার জন্য?

প্রিয় পাঠক, আপনারা পাশে আছেন বলেই এই গল্প এগিয়ে চলেছে। ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।

©ছায়া আলো – অনুমতি ছাড়া কপি বা পুনঃপ্রকাশ করা নিষিদ্ধ ❌

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ