কাব্য ও অরিণার প্রেম
অধ্যায় ১: রাতের যাত্রা
রাত তখন ২টা। আকাশে পূর্ণিমার আলো, চারপাশের পাহাড় যেন রূপালী পর্দা পরে আছে। পাহাড়ি রাস্তা—উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা, কোথাও গভীর খাদ, কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। রাস্তা পিচঢালা হলেও নির্জন, যত দূর চোখ যায়—মানুষ নেই, কেবল নীরবতা।
গাড়ির ভেতর বসে আছে কাব্য। এক হাতে স্টিয়ারিং, অন্য হাতে হালকা তাল মিলিয়ে গান শুনছে। গানটি ভ্রমণ নিয়ে, অজানার ডাক নিয়ে। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি জমে আছে, তবু মনে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
কাব্য কে? সে একজন ট্রাভেল ব্লগার। ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়ানোর নেশা তার ভেতরে। বয়স যখন কিশোর, তখন থেকেই ডায়েরিতে আঁকতে শুরু করেছিল ভ্রমণের গল্প। পরে ক্যামেরা হাতে পেয়েই সেই গল্পগুলো ছবিতে রূপ নিল।
আজ কাব্যের ব্লগ পড়তে হাজারো মানুষ অপেক্ষা করে। ইউরোপের পাহাড় থেকে এশিয়ার নদী—সবই সে ঘুরেছে। কিন্তু নিজের দেশ? বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষের হাসি, পাহাড়ি অরণ্যের গল্প—এখনও অজানা থেকে গেছে তার কাছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই সফর থেকে শুরু করবে নতুন যাত্রা। নিজের দেশকে নতুন করে দেখবে, ৬৪ জেলার প্রতিটি কোণা ঘুরে লিখবে “আমার বাংলাদেশ” নামে ভ্রমণকাহিনী।
গাড়ি পাহাড়ি পথে এগোতে এগোতে কাব্য গভীর নিঃশ্বাস নিল। তার চোখে ভেসে উঠল স্বপ্নের ছবি। তবে ক্লান্তিও আছে। সকাল থেকে একটানা ড্রাইভ করছে। চোখ ভারী হয়ে আসছে। হাই তুলল কয়েকবার। সে ভাবল, একটু থেমে যাওয়া দরকার।
রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করাল কাব্য। বাইরে নামতেই কানে এলো পাহাড়ি ঝরনার শব্দ। ঠান্ডা হাওয়া মুখে লাগল। কাব্য ঝরনার দিকে এগোল, হাতভর্তি ঠান্ডা পানি তুলে মুখে ছুঁড়ে দিল। শরীর জুড়িয়ে গেল এক মুহূর্তে।
তখনই—কানে এলো অদ্ভুত এক শব্দ। হাসি। কিশোরী মেয়েদের হাসির মতো। কাব্য থমকে দাঁড়াল। তার বুকের ভেতর ধকধক শব্দ বাড়তে লাগল। চারদিকে তাকাল—কোথাও কেউ নেই। পাহাড় নীরব, গাছপালাও স্থির। তবু হাসির শব্দ স্পষ্ট। যেন ঝরনার ওপার থেকেই ভেসে আসছে।
সে ধীরে ধীরে এগোল। চাঁদের আলোয় ঝরনার ধার চকচক করছে। ঝরনাধারা নেমে গেছে নিচের ছোট্ট খালে। আর সেই খালের ওপারে… কাব্যের চোখ থেমে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসলো। সেখানে—তিনটি পাহাড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা রাজপ্রাসাদ। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে তার দেয়াল। সামনে ঝকঝকে পানির ফোয়ারা। প্রাসাদের প্রবেশপথ সাদা ছোট ছোট পাথরে সাজানো, চারপাশে ফুলে ভরা বাগান। খালের ওপর একটি সেতু—সাদা রঙের, ছোট্ট, কেবল পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। ঝরনার কলকল শব্দ মিশে গেছে প্রাসাদের চারপাশে ভাসতে থাকা নীরবতার সাথে।
আর তখনই—সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মেয়েকে দেখতে পেল কাব্য। তাদের সাদা পোশাক, লম্বা খোলা চুল, চাঁদের আলোয় মুখগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। তারা হাসছে—কিন্তু সেই হাসির মধ্যে আছে অদ্ভুত রহস্য। কাব্যের চোখে চোখ পড়তেই তারা থেমে গেল। এরপর দৌড়ে চলে গেল প্রাসাদের ভেতরে। কেবল একজন থেকে গেল সেতুর মাঝখানে। তার পোশাক অন্য সবার থেকে আলাদা—রূপালি রঙের লম্বা পোশাক, চুলে ফুল গুঁজে রাখা। তার চোখে এমন এক দীপ্তি, যা কাব্যকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে। সে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল—“এসো…”
অধ্যায় ২: রহস্যময় হাসি
কাব্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুক ধকধক করছে, মাথার ভেতর হাজার প্রশ্ন ঘুরছে। এই পাহাড়ি অরণ্যের মাঝখানে রাজপ্রাসাদ কীভাবে এল? মেয়েরা কারা? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—সেই রূপালি পোশাক পরা মেয়েটি কে? চাঁদের আলোয় ঝরনার ফোঁটা ঝিকমিক করছে। বাতাসে মিশে আছে ফুলের গন্ধ। মনে হচ্ছে পুরো প্রকৃতি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেতুর দিকে।
কাব্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ভ্রমণ করেছে বহু দেশে, দেখেছে অদ্ভুত অদ্ভুত স্থাপত্য। কিন্তু এরকম স্বপ্নিল দৃশ্য কখনও নয়। সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি নীরব। তার চুল বাতাসে উড়ছে, রূপালি পোশাকে ঝরে পড়ছে চাঁদের আলো। সে কথা বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি যেন সরাসরি কাব্যের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
কাব্য এক পা এগোল। তার মনে ভয়ও কাজ করছে—যদি সবটা মায়া হয়? যদি ভূতের গল্পের মতো কিছু ঘটে? কিন্তু অদ্ভুত এক টান তাকে থামতে দিল না। ঝরনার ধারে এসে দাঁড়াল সে। খালের ওপরে ছোট্ট সাদা সেতুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। সেতুর দুই পাশে লতানো ফুল, যেন কেবল তার জন্য সাজানো। ঠিক তখনই মেয়েটি প্রথমবার কথা বলল। তার কণ্ঠস্বর যেন ঝরনার সুর, আবার বাতাসের ফিসফিসানি—“তুমি ভয় পাচ্ছো কেন, কাব্য?”
কাব্যের শরীর কেঁপে উঠল। সে নাম জানে! সে তো কখনও তার সাথে দেখা করেনি। কাব্য দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি? আমার নাম কীভাবে জানো?” মেয়েটি মৃদু হেসে সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। “আমরা বহুদিন ধরে তোমার অপেক্ষা করছি।” “আমরা?”—কাব্য প্রশ্ন করল। মেয়েটি আর কিছু বলল না। শুধু ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল—“এসো।” কাব্যের বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। সে জানে, একবার যদি সেতুতে পা দেয় তবে আর কিছুই আগের মতো থাকবে না।
অবশেষে কাব্য পা রাখল সেতুর প্রথম ধাপে। সেই মুহূর্তে মনে হলো সময় থেমে গেছে। বাতাস স্তব্ধ, ঝরনার শব্দ স্তব্ধ—শুধু তার হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে। সেতুতে পা রাখার সাথে সাথেই চারপাশ বদলে গেল। হাওয়া হয়ে উঠল ভারী, আকাশের তারা যেন কাছে নেমে এলো। গাছের পাতাগুলো সোনালি আলোয় ঝলমল করতে লাগল। এ যেন আর বাস্তব নয়, অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করছে সে। কাব্য ধীরে ধীরে এগোল। সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কাব্যর চোখ আটকে গেল তার চোখে—অদ্ভুত গভীর, যেন সেই চোখের ভেতরেই লুকিয়ে আছে পুরো আকাশ, পুরো পৃথিবী। হাত ধরতেই কাব্য অনুভব করল এক উষ্ণতা, আবার শীতলতা। এক মুহূর্তে সে ভুলে গেল নিজের পরিচয়, ভুলে গেল ক্লান্তি, ভুলে গেল পৃথিবীর সবকিছু। মেয়েটি ফিসফিস করে বলল—“এসো, তোমাকে আমাদের প্রাসাদ দেখাই।” সেতু পার হয়ে দু’জন একসাথে এগিয়ে গেল সাদা রাজপ্রাসাদের দিকে। ফুলের বাগান, পানির ফোয়ারা, ঝরনার সুর—সবকিছু যেন জীবন্ত স্বপ্ন। আর কাব্য বুঝতে পারল—তার জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় রাত শুরু হয়ে গেছে।
পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন
✦ কাব্যের জীবনে কী ঘটতে চলেছে? রহস্যময় প্রাসাদের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে? জানতে হলে পড়তে হবে পরবর্তী পর্ব।
প্রিয় পাঠক, আপনারা পাশে আছেন বলেই এই গল্প এগিয়ে চলেছে। ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য—শীঘ্রই আবার দেখা হবে।
